শীর্ষ নিউজসংগঠন সংবাদ

নিরাপদ নারীর চলার পথ , সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধে তারুণ্যের অঙ্গীকার

 

বাংলাদেশের জনস্থানে (পাবলিক প্লেস) শতকরা ৮৭ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশুর যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের ৬৬ শতাংশ জীবনে একবার হলেও এসব স্থানে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর ৭ শতাংশ প্রায়ই এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়ে থাকেন। নারী অধিকার মানবাধিকার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। মানবাধিকারের সব বিষয়ই নারী অধিকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানবাধিকারের সুরক্ষায় নারী ও কন্যা শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে নানা শ্রেণি পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বরিশালে এক যুব কর্মশালায় বলা হয়েছে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায়  সহিংসতা মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। আর এ জন্য তরুণ সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে নগরীর এবিসি ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’র আয়োজনে ‘”এডভান্সিং ইয়ুথ এক্টিভিজম টু এড্রেসঃ জেন্ডার বেইসড ভায়োলেন্স” ’ বিষয়ক এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে যৌথভাবে সহায়তা করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, ইউএনডিপি, সিআরআই এবং ইয়ং বাংলা। কর্মশালায় অংশ নিয়ে  বক্তারা বলেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর উপস্থিতি প্রতিনিয়ত বাড়ার সাথে সাথে নারীর প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে। লোকলজ্জা ও অপমানের ভয়ে নীরব না থেকে মুখ খুলতে হবে এবং সচেতন শ্রেণীকে নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াতে হবে।

কর্মশালায় অতিথি হিসেবে ছিলেন বরিশাল মহিলা কল্যাণ সংস্থার  পরিচালক কাওছার পারভিন, বহুমুখী সিটি হকার্স মার্কেটের সেক্রেটারি সাইফুল ইসলাম মনির, নারী নেত্রী হাসিনা আক্তার নিলা প্রমুখ।  কর্মশালায় রিসোর্স পারসন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রতীকি যুব সংসদের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ময়ুরী আক্তার টুম্পা। কর্মশালায় তরুণ সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ, সাংবাদিকবৃন্দ, এনজিও কর্মী, বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি ও পরিবহন সেক্টরের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। এসময় তরুণরা নারীর জন্য নিরাপদ চলার পথ নিশ্চিতে এবং জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা বন্ধে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন।

কর্মশালার শুরুতেই ইয়ুথনেটের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান শুভ নারীর নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিতে “উইমেন সেইফটি ইন পাবলিক প্লেস” ক্যাম্পেইনের ভূমিকা তুলে ধরেন। নারী ও কন্যা শিশুদের হয়রানি ও সহিংসতা বিষয়ে নিরবতা ভাঙ্গা, সময়ের সাথে সাথে আচরনে ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা, ভুক্তভোগী ও নির্যাতনের শিকার নারীদের সহিংসতা বন্ধে কথা বলতে উৎসাহিত করা, অপরাধীদেরকে দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট বার্তা দেয়া এই কর্মশালার অন্যতম লক্ষ্য।

মূল উপস্থাপনায় ময়ূরী আক্তার টুম্পা বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮.২ এবং ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রীয় ও জন জীবনের সবক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকার এবং চলাফেরার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ অনুযায়ী শ্রমবাজার ও কর্মক্ষেত্রে সমান অধিকারসহ সব ধরনের জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে প্রতীয়মান যে, জনস্থানে নারী ও মেয়ে শিশুদের ওপর হয়রানি বন্ধে বিদ্যামান আইন ও নীতিমালা গুলো যথেষ্ট নয়।

জনস্থানে নারীর নিরাপত্তায় ইয়াং বাংলা, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই), ইউএনডিপি ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক যৌথ জরিপে  উঠে এসেছে, সাধারণত ৪২ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশুরা জনস্থানে ইভটিজিংয়ের শিকার হন। এ ছাড়া ১৭ শতাংশ অশালীন আচরণের সম্মুখীন, ১২ শতাংশ শারীরিক বিভিন্ন স্থানে অবাঞ্ছিত স্পর্শ অনুভব ও ১১ শতাংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন।

সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, নারী ও কন্যাশিশুরা যৌন হয়রানির শিকার সব থেকে বেশি হয় গণপরিবহনে। জরিপে অংশ নেয়া ৩৬ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশু বাস, ট্রেন বা লঞ্চে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ২৩ শতাংশ নারী রাস্তা-ঘাটে, ১১ শতাংশ মার্কেট বা শপিং মলে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

সমীক্ষা অনুযায়ী, যৌন হয়রানি হওয়ার পরে ৩৬ শতাংশ নারী প্রতিবাদ করেছেন। অন্যদিকে প্রতিবাদ করেননি বা কাউকে জানাননি ৩৪ শতাংশ। এ ছাড়া ৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের অবহিত করেছেন, ৫ শতাংশ আশপাশের লোকদের সাহায্য চেয়েছেন এবং কেবল ১ শতাংশ নারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করেছেন।

সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৪৮ শতাংশ নারী নারীদের প্রতি সম্মানের অভাবকেই এসব যৌন হয়রানির কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ১৯ শতাংশ নারী জনবহুল গণপরিবহনকে ও ১০ শতাংশ নারী আইন প্রয়োগের অভাবকে এর জন্য দায়ী করেছেন।

কর্মশালায় অন্যান্য সমীক্ষার তথ্যও তুলে ধরা হয়। অ্যাকশন এইডের ২০১৫ সালের জরিপের তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের শতকরা ৯০ শতাংশই রাস্তা, বাজার বা বিপণিকেন্দ্র, গণপরিবহনসহ অন্যান্য জনস্থানে যৌন হয়রানি, সহিংসতা ও অবাঞ্ছিত শারীরিক স্পর্শের শিকার হন। ৮৪ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশু অবমাননাকর ও যৌন কটূক্তিমূলক মন্তব্যের শিকার হয়ে থাকেন। ২০১৮ সালে ব্র্যাকের সমীক্ষাতে ৯৪ শতাংশ নারী তাদের জীবনে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে উঠে এসেছে। অস্বস্তিকর অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার কারণে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী গণপরিবহন এড়িয়ে চলেন বলেও বিষয়টি উঠে আসে ওই সমীক্ষায়।

কর্মশালায় নারী অধিকার কর্মী কাওছার পারভীন বলেন, জনসমাগম স্থল ও চলার পথকে নারীদের জন্য নিরাপদ করতে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি রোধে জনসচেতনতার কোন বিকল্প নেই। একজন নারীর নিরাপত্তা ও চলার পথকে মসৃন করতে হলে, তাঁকে অবশ্যই উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর নিরাপত্তা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনসহ তরুণ সমাজ ও নাগরিকদের ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা দরকার।

 কর্মশালায় জানানো হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তরুণ সমাজ ও নাগরিকদের ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই), তরুণদের প্লাটফর্ম ইয়াং বাংলা, ইউএনডিপির মানবাধিকার কর্মসূচি  এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যৌথভাবে যুব সংগঠনদের সাথে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যার লক্ষ্য সহিংসতা ও হয়রানি বন্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত পরিবর্তন আনা এবং যৌথ হয়রানি বন্ধে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো তৈরি করা।
এ সময়ে অংশগ্রহণকারীরা গ্রুপ ওয়ার্কের মাধ্যমে নিজ নিজ জায়গা থেকে পরিকল্পনা তুলে ধরেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button