আঞ্চলিকশীর্ষ নিউজ

মণিরামপুরের ৫ সূর্য সন্তান আসাদ তোজো শান্তি মানিক ও ফজলুর শহিদ দিবস আজ

যশোরের মণিরামপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধকালীন নিহত পাঁচ সূর্য সন্তানের শহিদ দিবস আজ। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বীরমুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান মেলেনি শহিদ পাঁচ সূর্য সন্তান আসাদুজ্জামান আসাদ, মাশুকুর রহমান তোজো, সিরাজুল ইসলাম শান্তি, আহসান উদ্দীন মানিক ও ফজলুর রহমান ফজলুর। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও ক্ষমতার দাপটে বীরমুক্তিযোদ্ধা খেতাব পেয়েছেন এবং বহাল যথারীতি এমন নজির রয়েছে এই মণিরামপুর উপজেলায়।

শহিদ আসাদুজ্জামানের ভাই যশোর শিক্ষাবোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা মো. শফিকুজ্জামান বলেন, তার ভাইসহ পাঁচ শহিদ পরিবারের প্রতি শোক জানিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষরিত একটি চিঠি দেয়া হয়েছিল। এটাই বড় স্বীকৃতি। শুধুমাত্র একটা সার্টিফিকেটের জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করেছেন বলে তার পরিবারের কেউ বিশ্বাস করেন না। কিছু করার থাকলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে করা উচিৎ।

১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর উপজেলার চিনাটোলা বাজারের হরিহর নদের তীরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ও লবণ লাগিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের পরে রাজাকাররা এই পাঁচ সূর্য সন্তানকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। কিন্তু শহিদদের স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

ওই নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী চিনাটোলা বাজারের সরদার শ্যামাপদ নাথ (৭৭) এ প্রতিবেদককে বলেন, ওই সময় তিনি চিনাটোলা বাজারে মুটেগিরির (শ্রমিক) কাজ করতেন। ওইদিন রাজাকারদের নির্দেশে হরিহর নদীর ব্রিজের ওপরে চোখ বেঁধে রাত ৮টার দিকে মুক্তিসেনা আসাদ, তোজো, শান্তি, মানিক ও ফজলুকে আনা হয়। কিছুক্ষণ পর রাজাকার কমান্ডারের বাঁশি বেঁজে ওঠার সাথে সাথে গর্জে ওঠে অগ্নেয়াস্ত্র। মুহূর্তের মধ্যে পাঁচ তরতাজা যুবকের নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

জানা যায়, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের দক্ষিণ বঙ্গের নেতা নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বে এই ৫ নেতা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভবদহ এলাকার কপালিয়ার সানতলায় যুদ্ধ শেষে সাতক্ষীরা যাওয়ার পর তাদের যশোর শহরে যেতে বলা হয়। পথিমধ্যে আসাদ অসুস্থ হয়ে পড়লে উপজেলার রত্নেস্বরপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নিলে স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার আব্দুল মালেক ডাক্তারের নেতৃত্বে মেহের জল্লাদ, ইসহাক, আব্দুল মজিদ, আফসারসহ বেশ কয়েকজন রাজাকার ১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর তাদের আটক করে চোখ বেঁধে চিনাটোলা বাজারের পূর্বপাশে হরিহর নদীর ব্রিজে নিয়ে যায়।  সেখানে নিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের শরীরে লবন দেয়াসহ তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।

এ ব্যাপারে মণিরামপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আলা উদ্দীন জানান, এই পাঁচ সূর্য সন্তান স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। দেশে যেখানে যুদ্ধে অংশ না নিয়েও দলীয় ক্ষমতার জোরে কেউকেউ বীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাব পাচ্ছেন সেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন উদ্দোগ না নেয়া অমানবিক।

জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের যশোর জেলা শাখার সহ সাধারণ সম্পাদক কামরুল হক লিকু জানান, প্রতিবছর ২৩ অক্টোবর শহিদদের প্রতি বাম সংগঠনের উদ্যোগে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ কর্মসূচি নেয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ পর্যন্ত শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

জানা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ তাদের স্মৃতি স্মরণে কোনো উদ্যোগ নেয়া না হলেও শহিদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে স্বাধীনতার পর বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে প্রতিবছর ২৩ অক্টোবর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও তাদের জীবনী নিয়ে আলোচনা সভা করা হয়।

দিনটি স্মরণ করতে পরিচ্ছন্ন ও রঙ করানো হয়েছে শহীদদের সমাধিস্থল। রোববার (২২ অক্টোবর) ধোয়ামোছার কাজ করছিলেন ওমর আলী। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে তিনি সিরাজুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পরিচ্ছনতার কাজ করে আসছেন।

মণিরামপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার গাজী আবদুল হামিদ বলেন, সরকারিভাবে পাঁচ বীরকে মনে রাখা হয় না। শুধু ফজলুকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নেয়া হয়েছে। তিনি অন্যদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠানোর দাবি জানান। একই সঙ্গে এদেরকে স্মরণ করতে সরকারিভাবে স্মৃতিস্তম্ভ ও স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে উদ্যোগ নিতে বলেন আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, পাঁচ শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাদের কবরসহ উপজেলার সকল শহিদদের স্মৃতি ও বদ্ধভূমি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আলা উদ্দিন বলেন, স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির কর্মসূচিতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নিয়ে থাকি। উপজেলার সব শহীদের স্মৃতি ও বধ্যভূমি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে বলা হবে। সোমবার পাঁচ শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির উদ্যোগে ওই বধ্যভূমিতে সকালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button